লোডশেডিংয়ের টানে, কাছে আনে!

মেয়েটির নাম শোভা। থাকে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে। দেখতে যতটা সুন্দরী, তার চাইতে বেশি মনে হয় অহংকারী! আসলে মেয়েটিকে এভাবে ঠাস করে অহংকারী বলে ফেলাটা হয়তো আমার ঠিক হয়নি। কিন্তু কী করব বলেন? প্রথম দেখার পর থেকে শোভার সাথে কিঞ্চিত কথা বলার কত্ত ট্রাই করলাম, অথচ সে আমাকে কোনো পাত্তাই দিলো না। আরে বাবা, আমার চেহারা-সুরত না হয় সিনেমার নায়কের মতো না হয়ে অনেকটা ভিলেনের মতো হয়েছে। তাই বলে ভিলেন চেহারার লোকেরা কি মানুষ না? তারা কি কারো সাথে মনখুলে কথাও বলতে পারবে না? এগুলো ভাবতে ভাবতে প্রায়ই আমার মনটা উদাস হয়ে যায়।
দেখতে দেখতেই চলে আসলো গরমকাল। শীতের পর যেমন গরম আসে, ঠিক তেমনি গরম আসলেই লোডশেডিং আসবে এটাই স্বাভাবিক! আর তাই তো গরম আসতে না আসতেই লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে গেল কয়েকগুণ। এখন দিনের ১২ ঘন্টা (কখনো বা তারও বেশি সময়) বাসাবাড়িতে কারেন্ট থাকে না। এ তো গেল শহরের কথা, গ্রামাঞ্চলে কী অবস্তা তা একমাত্র গ্রামবাসীরই মালুম! তবে যেখানেই যত ঘন্টা লোডশেডিং হোক না কেন, এ নিয়ে দেশবাসী ওরফে সাধারণ জনগণের কোনো মাথা ব্যথা নেই। সকলের দাবি একটাই; আর তা হলো- কারেন্ট তো যায় না, মাঝে-মধ্যে আসে আর কি! তবে এ নিয়ে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই তা-ও কিন্তু নয়। আমার এক বন্ধু প্রায়ই বলে, বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুতের কোনো উন্নয়ন না হইলেও লোডশেডিংয়ের উন্নয়ন হইছে ব্যাপক হারে! তাই তো রাত আড়াইটার সময় ঘুম ভাঙলেও দেখি লোডশেডিং চলছে। আবার আরেক বন্ধুকে বলতে শুনি, সরকার ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌছাতে না পারলেও হারিকেনের আলো পৌছে দিয়েছে খুব সহজেই! পরের কথা ছেড়ে এবার নিজের কথায় আসি। ছোটবেলা থেকেই লোডশেডিং আমার খুব প্রিয় একটা জিনিসের নাম ছিল। কারণ একমাত্র লোডশেডিংয়ের অজুহাত দেখিয়েই স্কুলের হোমওয়ার্ক বা পড়ালেখা নিয়ে ফাঁকিবাজি করতে পারতাম। পেটে ব্যথা, মাথা ব্যথা, দাঁতে ব্যথা এসবের অজুহাতে হোমওয়ার্ক না করলে স্যারদের বেত্রাঘাত থেকে মুক্তি পাওয়াটা বেশ মুশকিল হয়ে যেতো। কিন্তু লোডশেডিয়ের অজুহাত দেখালে এক সেকেন্ডেই সব কিচ্ছা খতম হয়ে যেতো। সবাই বিশ্বাস করত যে ঘটনা সইত্য! কারণ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে নাই বা লোডশেডিং সম্পর্কে সাধারণ নলেজ নাই এমন ইনসান এই বাংলার মাটিতে হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না!
আমার এলাকায় মনে হয় গরমের মাত্রাটা অন্যান্য এলাকার চাইতে একটু বেশি। আর তাই তো সন্ধার পর লোডশেডিং হলে লোকজনকে হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতে করতে রাস্তায় নামতে দেখি। মাঝে মধ্যে আমারও ইচ্ছে করে তাদের সাথে যোগ দিতে, কিন্তু শরমের কারণে রাস্তায় আর নামা হয় না। তবে রাস্তায় না নামলেও লোডশেডিং হলে ঘরে বসে থাকতে পারি না। আর তাই বাতাস এবং মশার কামড় খেতে রওনা দেই বাড়ির ছাদের দিকে। আমার ছাদে যাওয়ার পেছনে অবশ্য আরো একটা কারণ আছে। আর তা হলো- যতবারই লোডশেডিং হয় ততবারই শোভাকে ছাদের দিকে রওনা হতে দেখা যায়। আর শোভা একা একা ছাদে গেলে আমি ঘরের মধ্যে একলা বসে থাকব নাকি? তাই আমিও তার পেছন পেছন ছাদে চলে যাই। তবে একসাথে ছাদে গেলেও শোভা কখনোই নিজ থেকে আমার সাথে কোনো কথা বলে না। আবার আমি তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে সে খুব নিখুঁতভাবেই আমার কথাগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। এভাবে এড়িয়ে যেতে যেতে একদিন, দুইদিন, তিনদিন করে সপ্তম দিনের মাথায় সে নিজ থেকেই আমার সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে এলো। এ দিন অন্যান্য দিনের চেয়ে গরমের মাত্রাটা মনে হয় একটু বেশি ছিল। আমি লোডশেডিংয়ের সময় ছাদে উঠে দেখলাম শোভা ছাদের মাঝখানে একটা শীতলপাটি বিছিয়ে বসে আছে। তখন গরমের কারণে শোভা তার ওড়না দিয়ে নিজের শরীরে বাতাস করছিল। কিন্তু এতে কি আর বাতাস লাগে? এ দিকে আমার হাতে ছিল একটা তালপাতার পাখা। এটি দেখে শোভা আমাকে মিষ্টি সুরে কাছে ডাকল। আমাকে বলল তার পাশে বসার জন্য। আমি বসার পর সে আমার হাতের পাখাটা তার হাতে দিতে বলল। আমি দিয়ে দিলাম। এর পর এটা দিয়ে সে বাতাস করতে লাগল দুজনার দিকে। সুযোগ পেয়ে আমিও তার হাতের বাতাস (সাথে মশার কামড়) খাচ্ছি এবং গল্প করে যাচ্ছি শোভার সাথে। এভাবে গল্প করতে করতে আমরা দুজন একসময় দুজনার ভালো বন্ধুতে পরিণত হলাম।
যেহেতু লোডশেডিং এখন প্রতিদিনকার সঙ্গী, তাই রুটিন করে আমরাও প্রতিদিন ছাদে উঠে গল্প করতে লাগলাম। আমাদের মাঝের বন্ধুত্বের বন্ধনটা হতে লাগল আরো গভীর থেকে গভীর। আর এর সবটাই সম্ভব হয়েছে একমাত্র লোডশেডিংয়ের কল্যানে!
প্রথম প্রকাশ: থেরাপি, নয়াদিগন্ত (১৪-০৩-২০১২)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন